মেজবাহউদ্দিন মাননুঃ বয়োবৃদ্ধ স্বামী মহিন রাঢ়ীকে নিয়ে সেলিনা বেগমের সংসারে এখন আর সুখ নেই। স্বামী প্রতিদিন সকালে মাছ বাজারে গিয়ে পাইকারি মাছ কিনে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে যা আয় তাই দিয়ে জোড়া-তালি দিয়ে চলছিল জীবন-জীবিকা। এখন স্বামী অসুস্থ থাকায় বেহাল অবস্থা। ছেলে-মেয়ে, ছেলে বউ নিয়ে নয় জনের সংসারের যোগান দিতে পাপরছেন না। ঈদ কেটেছে ধার-দেনায়। ইটবাড়িয়ায় বেড়িবাঁধের বাইরের এক চিলতে খাস জমিতে দীর্ঘ ২২টি বছর বসবাস করছেন এ দম্পতি। বাঁধের বাইরের কাঠের স্ট্রচারের টিনশেড একতলা ঘরটিতেও এখন জোড়া-তালি। জং ধরেছে চালে, বেড়ায়। তারপরও সারাদিন কাজ-কর্ম শেষে সন্ধ্যার পরে এই বসতঘরটিই তাদের যেন স্বস্তি দেয়। কিন্তু বেড়িবাঁধের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁদের গেট থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কটি প্রশস্ত করনের কাজ শুরু করেছে। তাই এই দম্পতিসহ ১৩৬টি পরিবারকে ঘর সরিয়ে অন্যত্র যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। গত তিন মাস ধরে এই খবরের পরে এ পরিবারটিসহ সবাই উচ্ছেদ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
সেলিনা বেগম জানান, তাদের টাকাপয়সার দরকার নেই। শুধু এক চিলতে জায়গা দরকার। যেখানটায় গিয়ে ফের একটি ঘর তুলে থাকতে পারতেন। এ জন্য দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন শতক খাস জমি চেয়েছেন।
একই দশায় আমেনা বেগম-জসিম প্যাদা দম্পতির। সংলগ্ন আন্ধারমানিক নদীতে মাছ ধরেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ইটভাঁটিতে কাজ করেন। শ্রমজীবী এ পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে সংসারের বোঝা ঠেলতে গিয়ে অসহায় হয়ে আছেন। তার ওপর বাঁধের ঢালের খাস জমির ঘরটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলায় দিশেহারা হয়ে গেছেন। দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই। কোন জায়গা নেই যেখানটায় যাবেন। বললেন, ‘ খাওয়া-লওয়া নাই। যেখানে থাকি সন্ধার পরে জীর্ণদশার ঘরটিতে গিয়ে একটু শান্তি পাই।’ তার দাবি অন্তত আশ্রয়ের জন্য এক চিলতে খাস জমি দেওয়া হোক। এলাকার বাসীন্দা ইব্রাহীম মিয়া জানান, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ যেখানেই জমি অধিগ্রহণ করেছে সেখানেই ঘর-জমিজমা, গাছপালার ক্ষতিপুরণ দেওয়ার পরও পাকা ঘর দিয়ে পুনর্বাসন করেছে। আর আমাদের ১৩৬ পরিবারকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা চলছে জোর করে। খালি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তার দাবি বালিয়াতলী খেয়াঘাটের রাস্তার পাশে, নতুন আবাসনের পাশে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর পাশে যে খাস জমি রয়েছে, ওই জায়গাটুকু তাঁদেরকে দেওয়া হোক।
ইব্রাহীম জানান, আমরা পুনর্বাসনের দাবিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন করেছি। মানববন্ধন করেছি। কেউ এক খন্ড খাঁস জমি দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। এখন এসব পরিবারের অন্তত পাঁচ শ’ সদস্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তা তারা নিজেরাও জানেন না।
এরা জানান, তাঁরা অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ। ২২-২৩ বছর আগে এই বাঁধের পাশে এসে ঝড়-জলোচ্ছ¡াস, অতিজোয়ারের ঝাপটার মুখে কোনমতে একটি ঘর তুলে বসবাস করে আসছেন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুলে পাঠাচ্ছেন। হাঁস-মুরগি পালন করছেন। সরকারিভাবে টিউবওয়েল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটানোর পরে অন্তত ঘরে এসে একটু স্বস্তিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে ছিলেন। এখন এই কয় মাস আছেন উচ্ছেদ আতঙ্কে। এসব পরিবারের প্রশ্ন ? যদি তাঁদের উচ্ছেদ করা হবে তাইলে কয়েক মাস আগে ১৩৬ পরিবারকে কেন মুজিব বর্ষের ঘর দিয়ে পুনর্বাসন করা হলো না। অসহায় পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
পায়রা বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, ভবিষ্যতে যদি পুনর্বাসনের পরিকল্পনা থাকে, তাইলে এসব পরিবারের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।