সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন
আকতার ফারুক শাহিন ও অমল মুখার্জি, কলাপাড়া।। অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে ৩শ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকা রাখাইন গ্রাম ছয় আনিপাড়া। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই গ্রামের জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে কীভাবে এখানকার রাখাইনদের পুনর্বাসন করা হবে তা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। রাখাইনরা চাইছে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পাশাপাশি তাদের যথাযথ পুনর্বাসন করা হোক। কিন্তু এ নিয়ে পায়রাবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পরিষ্কার নয়।
জানা যায়, অধিগ্রহণের নামে একটু একটু করে দখল করা হচ্ছে রাখাইনদের গ্রামটি। স্থানীয় প্রশাসন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও তাতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের মতে, এভাবে একে একে দখল হয়ে গেছে এলাকাজুড়ে থাকা রাখাইনদের আদি বাসস্থানগুলো। এবারও হয়তো সেভাবেই ভিটেমাটি ছাড়া হতে হবে তাদের।
কলাপাড়ার পায়রা বন্দরের অবস্থান। উপজেলা শহর থেকে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার পথে ৬ কিলোমিটার পথ পেরোলে পূর্বদিকে বন্দরের লিংক রোড। ওই সড়ক ধরে আবার ৫ কিলোমিটারের কিছু বেশি পথ অতিক্রমের পর প্রবেশদ্বার পায়রা বন্দরের। বিশাল সেই প্রবেশদ্বারের উত্তর দিকে খানিকটা এগোলে ছয়আনিপাড়া স্লুইসগেট।
এই স্লুইসের একটু পশ্চিমে রাখাইনদের গ্রাম ছয়আনিপাড়া। উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের এই গ্রামে এক সময় বাস ছিল কয়েকশ রাখাইন পরিবারের। এখন অবশ্য অবশিষ্ট আছে সামান্যই। ৬টি ঘরে বসতি ২৭ থেকে ২৮ জন রাখাইনের। পাড়ায় ঢুকলেই চোখে পড়ে উন্নয়ন প্রশ্নে দারুণভাবে পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবাসস্থল। গ্রামের ভেতরে থাকা ঘরগুলোর একটি থেকে অন্যটিতে যেতে পায়ে মাখতে হয় প্যাচপ্যাচে কাদা। নেই ভালো ড্রেনেজ কিংবা স্যানিটেশন ব্যবস্থা। এমনকি নেই বিদ্যুতের সংযোগও। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এতসব সমস্যা নিয়েও পূর্বপুরুষের ভিটেতে টিকে আছেন তারা। চাষাবাদ আর পশুপাখি পালনের পাশাপাশি তাঁত বুনে চলে সংসার। সেই ভিটেটুকুই এখন কেড়ে নিতে চাইছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চিদাংমো বলেন, ‘প্রতিদিনই বন্দরের লোকজন এখানে এসে আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলে। কিন্তু বলে না যে আমরা কোথায় যাব। বন্দরের এক বড় কর্তা গত মাসে এসে বলে ধানখালীর পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমাদের জমি-বাড়ি দেওয়া হবে। সেখানে আমরা কী করে থাকব? সেখানে তো বাঙালিরা থাকবে। আমাদের ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, কোনো কিছুই তো তাদের সঙ্গে মিলবে না। এখানে এই ছয়আনিপাড়ায় আমাদের মন্দির আছে। শত বছরের পুরোনো বটগাছ আছে। আমাদের বাড়িঘর। তারপরও আমরা বলেছি, কলাপাড়ায় আরও অনেকগুলো রাখাইনপাড়া আছে। তার যে কোনো একটির সঙ্গে আমাদের এই ছয় পরিবারের জন্য বাড়ি আর জমির ব্যবস্থা করে দিন। আমরা চলে যাব। গ্রামে আমাদের ঘর আছে। পুকুর আর পুকুরে মাছ আছে। গাছ আছে। সেগুলোও তো ফেলে যেতে হবে। এসবের বিনিময়ে আমরা ক্ষতিপূরণ চেয়েছি। তাও কেউ দিচ্ছে না। খালি বলে চলে যাও। কোথায় যাব? গত মাসে হঠাৎ করে ভেকু মেশিন নিয়ে এসে আমাদের গ্রামের চারপাশে মাটি কাটা শুরু করে বন্দরের লোকজন। আমরা সবাই মিলে বাধা দিয়েছি। ঘর গেলে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে কি খোলা আকাশের নিচে থাকব? তারপরও চলাচলের রাস্তা ভেকু মেশিন দিয়ে কেটে দিয়েছে। আমাদের গ্রামটিকে মাঝে রেখে তৈরি করা হয়েছে রিং বাঁধ।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইন থেইন প্রমীলা বলেন, ‘দলিল-দস্তাবেজ অনুযায়ী ছয়আনি গ্রামের পত্তন ১৭৮৪ সালে। প্রকৃতপক্ষে এই পত্তন অবশ্য আরও আগে। ৩শ বছরের পুরোনো এই গ্রামের জমি অধিগ্রহণের আগে আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি হলেও তা করা হয়নি। অথচ জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্রের ১০নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, আদিবাসী অধ্যুষিত কোনো জায়গায় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ প্রশ্নে সর্বাগ্রে স্থানীয়দের মতামত নিতে হবে। ব্রিটিশ আমলে পত্তন হওয়া এই গ্রামটিকে ন্যাশনাল হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারত সরকার। কিন্তু তাও করা হয়নি। ৭০-র দশকেও কলাপাড়ায় ৬০-৭০ হাজার রাখাইনের বাস ছিল। বর্তমানে আছে মাত্র আড়াই হাজার। তাদের জমি, পুকুর, শ্মশানসহ সবকিছু দখল হয়ে যাচ্ছে বলেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তারা। এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে দেশে আর কিছুই থাকবে না।’
জানতে চাইলে ভূমি অধিগ্রহন বিভাগে কাজ করা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারি পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এই বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই। সচিব অথবা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
এরপর বন্দর চেয়ারম্যান কমোডর হুমায়ুন কল্লোলের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন কেটে দেন। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সহকারী কমিশনার উম্মে হাবিবা মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব কেবল জমি অধিগ্রহণ করা। পায়রাবন্দরের অনুকূলে সেটুকুই করেছি আমরা। অধিগ্রহণ প্রস্তাবনা দেওয়ার সময় সেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গ্রাম থাকার কথা উল্লেখ করা হলে প্রাথমিক পর্যায়েই ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তেমনটা করা হয়নি। ছয়আনিপাড়ায় বসবাসরত রাখাইন পরিবারগুলোর বাড়িঘর, গাছ, মাছের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৯১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭১ টাকা ৭৫ পয়সার একটি আবেদন এসেছে। এই টাকা পরিশোধের একটি নোটিশও আমরা ৫ জুন দিয়েছিলাম। এরই মধ্যে ৮ জুন সাদেকুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ওই ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত করে। যে কারণে বিষয়টি আটকে যায়। করোনার বিধিনিষেধের কারণে আপত্তি নিষ্পত্তির বিষয়ে বসতে পারিনি আমরা। তবে এটি নিয়ে খুব একটা জটিলতা হবে না বলে আমার বিশ্বাস। খুব শিগগিরই অবকাঠামোগত ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যাবে রাখাইনরা।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক কামাল হোসাইন বলেন, ‘ছয়আনিপাড়ার রাখাইনদের বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছি আমি। সোমবার তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। তারা যে দাবি তুলেছে তা যৌক্তিক। আশা করি বৈঠকেই ভালো একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারব। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আমাদের জাতীয় সত্তার বাইরে নয়।
-৫জুলাই দৈনিক যুগান্তর প্রকাশিত।
© All rights reserved 2022 © aponnewsbd.com
Leave a Reply